Angikar Paribar

মানব সংকটের প্লাস্টিক

গত কয়েক দশক ধরে প্লাস্টিক থেকে তৈরি নানা দ্রব্য আমাদের জীবন ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে টুথব্রাশ থেকে শুরু, তারপর সারাক্ষণই আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্লাস্টিক দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল । বালতি, মগ, ঝুড়ি, চেয়ার, টেবিল, জলের পাইপ, সিরিঞ্জ, অটোমোবাইল শিল্পের উপাদান ইত্যাদি— আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক-দ্রব্যের তালিকা দীর্ঘ। এই সময় প্লাস্টিক-দ্রব্য-বিহীন জীবন কার্যত অসম্ভব। কিন্তু এ কথাও সত্য যে বিজ্ঞানের যে সব আবিষ্কার পরে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে, সেই তালিকায় প্লাস্টিক অন্যতম।
কিন্তু এই প্লাস্টিক বর্জ্যই বর্তমানে পরিবেশ তথা মানব সভ্যতার এক বড়ো সংকট । এই বর্জ্য পচনশীল নয় বলে হাজার বছর বা তারও বেশি সময় মাটি, জলাশয়-নদী-সাগরে থেকে যেতে পারে। এই সমস্যার মূলে রয়েছে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বা পাতলা ‘ক্যারিব্যাগ’ যাকে আমরা গদাবাংলাই পলিথিন বলতেই অভ্যস্ত । প্লাস্টিকের যুগে বর্তমানে অনেকেই থলি হাতে নিয়ে বাজারে যাওয়ার অভ্যাসই ভুলে গেছেন। খালি হাতে বাজারে যান আর ফেরেন অনেকগুলি ‘ক্যারিব্যাগ’ হাতে, কখনও বা এক জিনিসেই ২-৩ টে পলিথিন নিয়ে । আর তার পর ? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি, সেই পলিথিনের স্থান হয় ডাস্টবিনে বা বেশিরভগটাই যত্রতত্র ছুড়ে ফেলি ।
প্লাস্টিক নিয়ে ইউ.এন.ই.পি (UNEP)-র কিছু পরিসংখ্যান একবার দেখে নেওয়া যাক । তারা জানিয়েছেন—
১) পৃথিবীর মানুষ প্রতি বছর ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে;
২) ৮০ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতি বছর নদী-নালা হয়ে সাগরে জমছে, স্থলপথে ওই পরিমাণ বর্জ্য পরিবহণ করতে হলে প্রতি মিনিটে একটি করে ট্রাক লাগবে।
এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে সাগরে মাছের থেকে বেশি প্লাস্টিক থাকবে।
৩) আমরা নানা প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার করলেও, এর মধ্যে ৫০ শতাংশই এক বার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়; গত এক দশকেই আমরা সর্বাধিক প্লাস্টিক ব্যবহার করেছি ।
৪) আমরা প্রতি মিনিটে নানা ধরনের তরল পদার্থের সাথে ১০ লক্ষ প্লাস্টিকের বোতল ক্রয় করি;
৫) আমরা যত পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন করি তার অন্তত ১০ শতাংশই প্লাস্টিকজাত দ্রব্য।
১৯৫০-২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ৬৩০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমেছিল, এর মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়েছে, ১২ শতাংশ সঠিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে জ্বালানো হয়েছে আর বাকি ৭৯ শতাংশ বর্জ্য যত্রতত্র আজও পড়ে আছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালে ১২০০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য পৃথিবি জুড়ে জমা হবে ।

এবার প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে ক্ষতির দিকে একবার নজর দেওয়া যাক..
১. ফোমের কাপ, ডিম, মাংস ইত্যাদি রাখার জন্য ব্যবহৃত ট্রে/পাত্র পোড়ালে বিষাক্ত স্টাইরিন গ্যাস নির্গত হয় এবং নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বা লোমকূপ দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে; দীর্ঘ কাল এই বিষ মানবদেহে প্রবেশ করলে মাথাধরা, ক্লান্তি, দুর্বলতা এমনকি স্নায়ুতন্ত্র বিকল হওয়ার মতো জটিল রোগ দেখা দেয়।
২. ভারতের নানা শহরের প্রান্তে পাহাড়ের মতো জমে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্যে আগুন লাগলে মোনোমার, ডাইওক্সিন ও ফুরানের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক মানবদেহে এ নানা ক্ষতি করে।
৩. প্লাস্টিক পচনশীল নয় বলে হাসপাতাল ও অন্যান্য চিকিৎসা ক্ষেত্রের প্লাস্টিক বর্জ্য দীর্ঘ দিন ধরে রোগ ছড়াতে থাকে ।
৪. একবার ব্যবহার করে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক জমে শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এই উপমহাদেশে বর্ষাকালে কম সময়ের মধ্যে অতিবৃষ্টি হবে। এক দিনে ৩০০-৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে প্লাস্টিক জমে বন্ধ হয়ে যাওয়া নালা দিয়ে অত জল বেরোতে পারে না। এই ভাবেই ২০০৫ সালে মুম্বই এবং ২০১৫ সালে চেন্নাই প্লাবিত হয়েছিল। আর প্লাস্টিক জমে কলকাতা আর শহরতলীর নিকাশি অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন ।
৫.অন্য এক ধরনের দূষণের কথা অনেকেরই জানা নেই। আপাত অদৃশ্য প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিক মারাত্মক ক্ষতি করে। একটি গাড়ি ১০০ কিলোমিটার চললে অন্তত ২০ গ্রাম প্লাস্টিক কণা বাতাসে, মাটিতে বা জলে মিশে যায়। ২০১৭ সালের এক গবেষণায় জানা গেছে পৃথিবীর ৮৩ শতাংশ কলের জলে প্লাস্টিক কণা মিশে থাকে এবং এমনকি পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিও এই দূষণ থেকে মুক্ত নয়।
৬. পৃথিবীর নয়টি দেশে পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে, বাজারে বিক্রি হয় এমন প্রতি লিটার জলে গড়ে অন্তত ৩২৫টি প্লাস্টিক কণা থাকে। সমীক্ষা জানাচ্ছে, বছরে তিন থেকে চার হাজার প্লাস্টিক কণা পানীয় জলের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করাও অসম্ভব নয়।

জীবনযাত্রার মান যত উন্নত হচ্ছে, শহরাঞ্চলে বর্জ্যের পরিমাণও ততই বাড়ছে; ২০১১ সালে ভারতে উৎপাদিত মোট বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৬৬০ লক্ষ টন, ২০৩১ সালে তা বেড়ে হবে ১৬৫০ লক্ষ টন আর ওই পরিমাণ বর্জ্য ফেলার জন্য অন্তত ৬৬৬ বর্গকিমি জমি প্রয়োজন হবে। এই ৬৬০ লক্ষ্য টন প্লাস্টিকের মধ্যে আমার অবদানও কিন্তু কোনো অংশে কম নয় ।